দীপশিখা মেটি স্কুল, একটি ব্যতিক্রমী শিক্ষাঙ্গন
![]() |
দীপশিখা মেটি |
রুদ্রাপুর, দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত প্রত্যন্ত একটি গ্রাম।
১৯৯৯ সালের আগে এই গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাশের গ্রামে যেত পড়ালেখার জন্য। এই কষ্ট দূর করার জন্য এবং গ্রামের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য দীপশিখা নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রুদ্রাপুর গ্রামে ছোট্ট পরিসরে ‘মেটি স্কুল’ গড়ে তোলে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের নাচ, গান, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা এবং ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন হাতের কাজ শেখানো হয়। বর্তমানে শিশু শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়।
এই স্কুলের উদ্দেশ্য আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, যুক্তিযুক্ত চিন্তার বিকাশ ও দলীয়ভাবে শিক্ষা গ্রহণ।
মেটি মূলত একটি সংগঠনের নাম। পুরো নাম মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি)। কম খরচে এবং হাতের নাগালের জিনিসপত্র ব্যবহার করে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে মেটি।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিরল উপজেলার রুদ্রাপুর গ্রামে মেটির অত্যাধুনিক মাটির স্কুলঘর নির্মাণ শুরু হয়, জার্মানির ‘শান্তি’ নামের একটি দাতা সংস্থার অনুদানে। অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এ স্কুল নির্মাণে অবদান রাখেন। সহযোগিতা করেন দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরাও। জার্মান স্থপতি অ্যানা হেরিঙ্গার ও এইকে রোওয়ার্ক এই ভবনের নকশা করেন।
মেটি স্কুল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু ও বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়াল, যাতে দেয়ালে ফাটল ধরতে না পারে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি দেয়ালে লাগলে খড়ের জন্য তা নেমে যাবে। দেয়াল তৈরির পর সুন্দর করে সমান করা হয়েছে।
দেয়ালের প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। মেঝের প্লাস্টারের জন্য পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ওয়াটারপ্রুফ। বাইরে থেকে প্লাস্টার না করায় স্বাভাবিকভাবে উপকরণগুলো চোখে পড়ার মতো।
মেটি স্কুল ছয় কক্ষবিশিষ্ট মাটির তৈরি একটি দোতলা ভবন। এই স্কুলটির আয়তন আট হাজার বর্গফুট। ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭ লাখ টাকা।
এই স্কুলটি নির্মাণের পর থেকে অনেকের কাছেই এখন গ্রামটি পরিচিত। এই স্কুলের নির্মাণশৈলী দেখার জন্য প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসে।
দিনাজপুর মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে দীপশিখা মেটি স্কুলটি অবস্থিত। বর্তমানে রাস্তা ধরে স্কুলটি দর্শনে যাওয়ার সময় তেমন বেগ পেতে হয় না। বিকেল ৫ টার পর মূল দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। দুই পাশে সবুজ ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে স্কুলটিতে যাওয়ার পথ। এই পথ দিয়ে যেতে ক্লান্তি আমাকে এতটুকুও স্পর্শ করেনি। দিনাজপুর টেকনিক্যাল মোড় রিজার্ভ নেয়া লোকাল ভ্যানে চড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে, করতে কখন স্কুলের গেটে পৌঁছে যাই তা টেরই পাইনি। ভেতরে প্রবেশ করার পর কিছু সময়ের জন্য থমকে যাই। ভাবতে থাকি মাটি আর বাঁশ দিয়ে এত সুন্দর নির্মাণশৈলী হতে পারে! সত্যিই এই স্কুলের নির্মাণশৈলী দেখে আমি মুগ্ধ। স্কুলের ভবনগুলো তিনতলা পর্যন্ত। ভবনের প্রতিটি তলার সামনে লম্বা বারান্দা এবং পেছনে উঁচু থেকে নিচু করে সুন্দর একটি পথ তৈরি করা হয়েছে।
নিচ তলা থেকে তিন তলায় যাওয়ার জন্য কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। সেই সাথে পেছনের পথ দিয়েও নামা ও ওঠার সুযোগ রয়েছে।ভবনগুলো একসাথে না। একটা ভবন থেকে আরেকটা ভবন বেশ দূরে স্থাপিত। প্রতিটি ভবনের সামনে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে। নতুন ভবনের পেছনের ঘাট বাঁধানো একটি পুকুর আছে। পুকুরের চার পাশে আছে গাছ। প্রতিটি ভবনের সামনে রয়েছে মাঠ। মাঠে ছাত্রছাত্রীদের জন্য দোলনা, স্লিপারসহ খেলাধুলার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে।
তবে নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি আমাকে আরো বেশি বিমোহিত করেছে পুরো স্কুল জুড়ে শিশুদের মুক্ত বিচরণ! এ যেনো বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য এক উন্মুক্ত প্লে গ্রাউন্ড। ক্লাসে উঁকি দিয়ে দেখলাম বাচ্চারা শুয়ে-বসে, হেসে-খেলে পাঠ নিচ্ছে। কত সহজ, সাবলিল ভাবে সবকিছু চলছে!
মাঠ থেকে একটু পেছনে গেলে দুই তলার একটি লাইব্রেরি চোখে পড়ে। লাইব্রেরিটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে দেখে মনে হবে ডুপ্লেক্স কোনো বাড়ি। স্কুল চলাকালীন সময়ে গিয়েছি বিধায় লাইব্রেরিতে যাওয়ার পারমিশন মিলেনি। যেহেতু স্কুলটি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, তাই একটি বড় কক্ষে অনেক সেলাই মেশিন দেখা গেল। মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই একটি দৃষ্টিনন্দন ভবন আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই ভবনে জার্মান ও অস্ট্রিয়ার কয়েকজন শিক্ষক এবং আমাদের দেশের কয়েকজন শিক্ষক পরিবারসহ থাকেন। স্কুলের আবাসিক অংশে যে কোনো প্রকার দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধ রয়েছে।
পরিবেশবান্ধব এই স্কুলটির নির্মাণশৈলী সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সবুজের মাঝে একেকটি ভবন দেখে মনে হয়েছে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি করা হয়েছে চমৎকার এই দীপশিখা মেটি স্কুলটি।
স্কুলটিতে কিছু যায়গায় ছবি তোলার পারমিশন থাকলেও ভিডিও নেয়ার জন্য আপনাকে কতৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। তবে ক্লাসের অভ্যন্তরীণ কোনো ভিডিও নেয়ার অনুমতি মিলবে না।
দীপশিখা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তাই দর্শনার্থীদের এটা মাথায় রেখে সেখানে অবস্থান করতে হবে।
পরিশেষে আমাদের চার পাশে অনেক সুন্দর নির্মাণশৈলী রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর খোঁজ আমরা রাখি না। সেগুলোর সৌন্দর্যও আমরা অনুভব করতে পারি না। অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ আমার এই সোনার দেশ। তাই বিদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করার আগে আমি এই বাংলার রূপ হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে চাই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন