লংগদু-রিজার্ভ বাজার নৌপথ ভ্রমণ। পাহাড়ের ভাজে লুকিয়ে থাকা একটি অনিন্দ্য সুন্দর নৌপথ।

আজ আমি আপনাদের বাংলাদেশের অন্যতম  সুন্দর এক নৌপথের গল্প বলবো। 

আচ্ছা পাহাড়ের কথ ভাবতেই আমাদের মাথায় কি ভেসে আসে? উঁচুনিচু সরু পথ, মেঘের কাছে পৌছে যাওয়া, ঝিরি ঝর্ণা আর চারিদিকে অবধারিত সবুজ!


আপনাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছে নৌপথের গল্পে পাহাড়ের আলাপ কেন!  

কারণ এই পাহাড়েই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের অন্যতম অনিন্দ্য সুন্দর কিছু  নৌপথ। সে পথে ভ্রমণের গল্প নিয়েই আজকের লেখা। 


ঢাকা থেকে মারিশ্যার টিকিট কেটে যাত্রা শুরু করি, কুমিল্লা পৌঁছে একটা দুঃসংবাদ পাই।

বাস মারিশ্যা পর্যন্ত যাচ্ছে না। যাবে খাগড়াছড়ি শহর পর্যন্ত! 


পরিস্থিতি মেনে নিয়ে ফের খাগড়াছড়ি উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে  সকালে সাড়ে সাতটা নাগাদ খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছি। কিন্তু সেখানে মারিশার  কোন গাড়ি না পেয়ে ২ হাজার টাকায় একটি রিজার্ভ সিএনজি নেই। কিছুদুর সামনে এগুনোর পরেই পুলিশ আমাদের আটকে দেয়। এসকোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে!  মিনিট তিরিশেক অপেক্ষার পর ফের রওনা দিই। গন্তব্য দিঘীনালা।


আমাদের সিএনজি ড্রাইভার এর পরামর্শে দিঘীনালা তৃপ্তি হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে ফের রওনা দিই।

আমাদের এখনকার  গন্তব্য লংদু লঞ্চ ঘাট। 

দীঘিনালা থেকে লঙ্গদুরু দুরুত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আর পুরো রাস্তাটাই নজর কারা। 


রাস্তার দুপাশের ধানি জমি, ,  বাঙালি পাহাড়ি ও আদিবাসীদের লোকালয়, বাজার, বিচরণ  দেখতে দেখতে আমরা এগুচ্ছি।  পথিমধ্যে আর্মি ও বিজিবির চেকপোস্ট ও পার হতে হলো। 

 লংগদু বাজার পৌঁছি দুপুর ১২ টায়। পরে লঞ্চের খোঁজ নিয়ে জানতে পারি লঞ্চ আসবে দুপুর দেড়টায়।  এর ফাকে লংগদু বাজার টা ঘুরে দেখে পরে  স্থানীয় মানুষদের সাথে খোশগল্প করতে থাকি। এরমধ্যে দেখলাম স্থানীয় এক লোক লেক থেকে কাঁকড়া ধরছে।

লংগদু ঘাট এখানকার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। এক সময় এটিই ছিলো এখানকার প্রাইমারি যোগাযোগ মাধ্যম। 


অপেক্ষার পালা শেষ করে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লঞ্চের হুইসেল সোনা গেলো। কাঠবডির দ্বিতল লঞ্চ সদর্পে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। 

লঞ্চ ঘাটে ভিড়ানো মাত্রই আর দেরী না করে উঠে পরি।

লঞ্চ ছাড়ার সাথে সাথে শান্ত লেকের পানি দু'ভাগ করে ছুটলো জাপানি হিনো ইঞ্জিনের দুই তলা বিশিষ্ট কাঠের লঞ্চটি।

দুইতলা এই লঞ্চের নিচতলা ডেক সিস্টেম আর উপর তলায় সারি সারি করে বেঞ্চপাতা রয়েছে।  আমি সরাসরি দ্বিতীয়তলায় ঢুকে বেঞ্চে বসে পড়লাম। চেষ্টা করলাম জানালার পাশের সিট ধরতে। 

এবার লঞ্চটাকে এক্সপ্লোর করার পালা।  

লষ্টের লোয়ার ডেকে সাধারণ সিট ও মালামাল রাখার জায়গা।  একেবারে পেছনে ইঞ্জিন রুম এবং তার পিছনে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে। আপার ডেকে গেট দিয়ে ঢুকতে শুরুতেই হাতের বামে মাস্টার কেবিন তারপরে সারি সারি বেঞ্চ।  পেছনে দরজা দিয়ে বের হয়ে একটু খালি জায়গা আর তার ডান পাশে ওয়াশরুম।  এর সামনে উচু একটা ছাদের মত যায়গা। মূলত এখানটায়ও মালামাল রাখা হয়।  আর ছাদের মত জায়গাটিতে মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলো। 



এবার আসি এই নৌ রুটের বিষয়ে। আমাদের লঞ্চ তখন মাইনি নদী পয়ে কাটতলী দ্বীপ পার হচ্ছে।  পথিমধ্যে লঞ্চ অনেকগুলো ঘাট ধরেছে যোগুলোর লোকাল নাম আমি অলরেডি ভুলে গেছি।

লঙ্গদু থেকে রাঙ্গামাটি  এই রুটটি  প্রায় ৭৬ কিলোমিটার। 

এখান থেকে প্রতিদিন ৪টি লঞ্চ পাওয়া যায়। আপার ডেকের ভাড়া জনপ্রতি  ২১০ টাকা এবং লোয়ার ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ১৭০ টাকা।  এই পথ পারি দিতে অলমোস্ট সারে ৪ ঘন্টা লাগে!

একমাত্র বর্ষার শুরুর দিকে অথবা অক্টোবর-নভেম্বরে লেকের পানি যখন  কমতে শুরু করে তখনি এই নৌরুট টি দেখার আদর্শ সময়।


তবে আনিন্দ সুন্দর এখন বিপন্নের মুখে। গ্রীষ্মকালে পুরো রুটের চেহারাই বদলে যায়।  পরিবেশ বিপর্যয়, নির্বিচারে বন উজাড়, নাব্যতা সংকট ও অনাবৃষ্টির কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ রাঙামাটির ‘কাপ্তাই হ্রদ’। 

১৯৬০ সালে ৭২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সৃষ্টি কাপ্তাই হ্রদের এখন বয়স প্রায় ৬৪ বছর। বয়সের ভারে নাব্য সংকটে পড়া কাপ্তাই হ্রদের ড্রেজিং নিয়ে শুধু কথার পিঠে কথা হয়েছে, কাজ শুরু করা যায়নি আজ পর্যন্ত। এই ৬৪ বছরে বর্জ্য ও উজান হতে নেমে আসা পলিতে কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ ভরাট হতে হতে প্রতি বছরই পুরনো চরগুলোর সাথে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন চর। সংকুচিত হয়ে আসছে প্রতিটি নৌরুট। যার ফলে, চলতি বছর গ্রীস্ম মৌসুমে বাঘাইছড়ি, বরকল, লংগদু, নানিয়ারচর, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সাথে সংযুক্ত ৬টি নৌরুটে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ বাসিন্দার দুর্ভোগ-দুর্দশা চরমে উঠেছে।


আমাদের লঞ্চ আপন গতিতে এগিয়ে চলছে এর মধ্যে আমি মাস্টারের কেবিনে গিয়ে তার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি।  প্রায় আড়াই ঘন্টা পর শুভলং ঘাটে আমাদের লঞ্চ ভিরে তবে এখানটায় ছবি অথবা ভিডিও করার পারমিশন নেই, লোক তোলা শেষ হলে ফের আমাদের লঞ্চ যাত্রা শুরু করলো।  

এখন রুটের চেহারা পুরো আলাদা দুই পাশে দেয়ালের মত বিশাল খারাপ পাহাড়।  মাঝখানে লেকের গভীর নীল জলরাশি ভেদ করে এগিয়ে চলছে আমাদের লঞ্চ, একটু সামনে যেতেই শুভলং ঝর্ণা দৃষ্টিগোচর হল স্বাভাবিকভাবেই ঝর্ণা এখন কোন পানি নেই আমরা এগিয়ে চলছি। এখান থেকে রিজার্ভ বাজার আর মাত্র ৫০ মিনিটের পথ।  ততক্ষণে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসবে। 

হলোও তাই, লেকের শান্ত জলে  শেষ বিকেলের সোনালী কিরণ আমায় বিমোহিত করে রেখেছিলো। 

এতো চমৎকার একটা জার্নির ইতি ঘটতে যাচ্ছে

এটা ভেবেই কেমন মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো!


আমরা ফাইনালি রিজার বাজার পৌঁছে গেলাম। 


এই সারে ৪ ঘন্টার নৌ ভ্রমণটা ছিল এক কথায় একটা এপিক জার্নি। কি নেই এখানে! ক্ষণে ক্ষণে নতুন চমক। জেলেদের মাছ শিকার, লেকের পাড়ের মানুষদের জীবন জীবিকা, দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার শান্ত লেকের জল, লেকের মাঝে মাথা উঁচু করে জেগে থাকা অসংখ্য ছোট বড় দ্বীপ। লঞ্চের ছাদে বসে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে এমন  দৃশ্য অসাধারণ। 


রিজার্ভ বাজার নেমে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কাপ্তাই।  অলরেডি সন্ধ্যে  হয়ে গেছে। এই সময়ে সিএনজি পাওয়ার একটু মুশকিল।  

এখান থেকে কাপ্তাই এবং পরবর্তী ভ্রমণের  গল্প আরেকটি পর্বের জন্য তোলা থাকলো!


পুরো ভ্রমণ অভিজ্ঞতাটি ভিডিও আকারে দেখতে চাইলে-

https://youtu.be/Rm_yp35kdkA?feature=shared



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ি ( ভাগ্যকূল জমিদার বাড়ি)